স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী
স্বামী বিবেকানন্দ ১৯৬৩ সালের ১২ ই জানুয়ারি কলকাতা শহরের একটি উচ্চবিত্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।স্বামী বিবেকানন্দের ডাক নাম ছিল বিলো, ভালো নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। নরেন্দ্রনাথ দওের পিতার নাম বিশ্বনাথ দত্ত। স্বামী বিবেকানন্দের পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন উত্তর কলকাতার নামকরা আইনজীবী।স্বামী বিবেকানন্দের মাতার নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। পেশায় তিনি ছিলেন গৃহিণী।
ইনি ভারতবর্ষের ইতিহাসে একযুগ পুরুষ। তারই মধ্যে একই সাথে মিশেছে ঈশ্বর প্রেম,মানবপ্রেম আর স্বদেশ প্রেম। তার জীবন ছিল মুক্তির সাধনা-সে মুক্তি জাতির সর্বাঙ্গীণ মুক্তির।অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রেই মানুষ যেন নিজেকে সকল বন্ধন এর উর্দ্ধে নিয়ে যেতে পারে। সন্ন্যাসী হয়েও ঈশ্বর নয় মানুষ ছিল তাঁর অবাধ্য দেবতা।
নরেন্দ্রনাথ দওের জীবন সর্ব মানুষের কাছেই এক আদর্শ হয়ে আছে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন,ঈশ্বর নয় মানুষ।মানুষের মধ্যেই ঘটবে ঈশ্বরের পূর্ণ বিকাশ। তিনি যুগ-যুগান্তরের প্রথা ধর্মসংস্কার ভেঙে ফেলে বলে উঠেছিলেন আমরা অমৃতের সন্তান।
স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব কাল এমন একটা সময় হয় যখন বাংলার বুকে শিক্ষা,সাহিত্য,ধর্ম,সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রেই নবজাগরণের যুগ শুরু হয়েছিল। কলকাতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে লেগেছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। শুধু পড়ালেখাতেই নয় বক্সিং ও কুস্তিতেও তিনি ভালো খেলতেন।এছাড়াও তিনি ক্রিকেটও খেলতেন।
শিক্ষাজীবন
স্বামী বিবেকানন্দ বাড়িতে গুরু মহাশয়ের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে নরেন্দ্রনাথ দত্ত ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন । ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে দত্ত পরিবার কলকাতায় ফিরে আসলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উর্ত্তীন্ন হন।তিনি বরাবরই মাসের সেরা ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
১৮৭৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নরেন্দ্রনাথ জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশনে এসে পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানকার অধ্যক্ষ ছিলেন ইয়ুলিয়ম হেস্টিং।ইউলিয়ম হেস্টিং এর সান্নিধ্যে এসে দেশ-বিদেশের দর্শনশাস্ত্রের প্রতি স্বামী বিবেকানন্দ আকৃষ্ট হয়েছিলেন।তার সহপাঠী ছিলেন ডঃ ব্রজেন্দ্রনাথ শীল।পরবর্তীতে তিনি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। যেটি পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বড় পাওয়া ছিল তার কাছে।
১৮৮০ সালে ঠাকুর রামকৃষ্ণ সিমলা পল্লীতে সুরেন্দ্রনাথ মিত্র বাড়িতে এসেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। আর সেখানেই প্রথম রামকৃষ্ণের সাথে পরিচয় হয়েছিল নরেন্দ্রনাথের।নরেন্দ্রনাথের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে ঠাকুর তাকে দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে নরেন্দ্রনাথের রামকৃষ্ণের কথা ভুলে যান।
কিছুদিন পর নরেন্দ্রনাথ যখন রামকৃষ্ণের কাছে যাতায়াত করতেন তখনও তিনি নিয়মিত ব্রাহ্মসমাজে যেতেন। কোন একদিন ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাকে যখন স্পর্শ করেছিলেন তিনি মুহূর্তের মধ্যে নিজের চেতনা হারিয়ে ছিলেন ।তার কাছে এটাই মনে হয়েছিল যে তার সমস্ত সত্তা এক অনন্তের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছে।
সাফল্য অর্জন
স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব কাল এমন একটা সময় হয় যখন বাংলার বুকে শিক্ষা,সাহিত্য,ধর্ম,সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রেই নবজাগরণের যুগ শুরু হয়েছিল। কলকাতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে লেগেছিল আধুনিকতার ছোঁয়া।
তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে হিন্দু ধর্ম তথা ভারতীয় বেদান্ত ও যোগ দর্শন প্রচারে প্রথম ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে চিকাগো বক্তৃতা, রাজযোগ, জ্ঞানযোগ, হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বেদান্ত, কর্মযোগ, ভারতে বিবেকানন্দ, ভাববার কথা, পরিব্রাজক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বীরবাণী, মদীয় আচার্যদেব অন্যান্য।
বিবেকানন্দ গায়ক ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন তার রচিত বিখ্যাত গান দুটি হলো খন্ডন-ভবো-বন্ধন ও নাহি সূর্য নাহি জ্যোতি।
ভারতে বিবেকানন্দ বীর সন্ন্যাসী উপাধি পান ভারতের তার জন্মদিনটি জাতীয় যুব দিবস হিসেবে পালিত হয়। শুধু পড়ালেখাতেই নয় বক্সিং ও কুস্তিতেও তিনি ভালো খেলতেন। এছাড়াও তিনি ক্রিকেটও খেলতেন।
শেষ জীবন
১৮৮৫ সালে ঠাকুর রামকৃষ্ণ গলার ক্যান্সারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল কাশীপুর উদ্যানবাটী তে। তখন নরেন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন তীব্র ব্যাকুলতা, চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি কাশীপুর উদ্যানবাটী দেশের অন্য ভক্তদের সাথে ঠাকুরের শ্রী চরণে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অন্য বক্তারা প্রথম দিকে মাঝে মাঝে গৃহে যেতেন ধীরে ধীরে তাও বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। উদ্যানবাটি হয়ে উঠেছিল রাম কৃষ্ণ ভক্ত শিষ্যদের আশ্রম। রামকৃষ্ণ ১৮ জনকে সন্ন্যাস উদ্বোধন করেছিলেন। তারমধ্যে বিবেকানন্দ ছিল অন্যতম।
1886 সালের এপ্রিল মাসে স্বামী বিবেকানন্দ কে সাথে নিয়ে গভীর যাত্রা করেছিলেন রামকৃষ্ণ।সেখান থেকে গিয়েছিলেন বুদ্ধগয়ায়। সেখানে গিয়েই তার মধ্যে জেগে উঠেছিল বুদ্ধের মহামুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
বুদ্ধের মত মনুষ্য কে সকল যন্ত্রনা দুঃখ থেকে মুক্তির পথ দেখার জন্যই তার আবির্ভাব হয়েছিল।এখানে বৌদ্ধ সাত্তার মন্দিরে ধ্যানস্থ হয়ে গেলেন স্বামীজি। কিন্তু ১৮৮৮ সালের ১৫ ই আগস্ট গৃহত্যাগ করেন।
রামকৃষ্ণ চলে যাওয়ার পর স্বামীজীর মধ্যে ভারতবর্ষের সব মহাপুরুষদের সৎ গুনের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল। ১৮৮৮ সালে স্বামী বিবেকানন্দের ভারত পরিক্রমা শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। স্বামীজি যখন যেখানে গিয়েছিলেন।
যারাই তার সান্নিধ্যে এসেছেন তাঁর ব্যক্তিত্ব,পাণ্ডিত্য সদ্য প্রসন্নময়ী মুখমন্ডলের দিকে চেয়ে সকলেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। কোন একজন স্বামীজি স্বপ্নের মাঝে দেখছিলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণ জনতাকে সমুদ্র পার হয়ে বিদেশ যাত্রায় ইঙ্গিত দিলেন।এটা দেখার পর তিনি কোনো এক কারণে আমেরিকা যাত্রা করেছিলেন। সেখানে গিয়ে স্বামীজি বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার সুযোগ পেয়েছিলেন।
এই সুবাদে স্বামীজি দক্ষিণ চীনের রাজধানী ক্যান্টনমেন্টে ঘুরে এসেছিলেন।তার গভীর দৃষ্টি দিয়ে প্রত্যক্ষ করেন। চীনের মানুষের দুঃখ দূর্দশা। ১৯৮৬ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর তিনি ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর বিদেশ যাত্রা শেষ হলো।
১৮৮৭ সালের ১৫ ই জানুয়ারি তিনি কলম্বো এসে পৌঁছান। তারপর ২০ জানুয়ারি কলকাতায় এসে পৌঁছান। সেদিন সমস্ত কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। কলকাতা তথা ভারতবর্ষের মানুষ সেদিন তাদের অন্তরের সব শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও উজার করেছিল স্বামীজীর পদপ্রান্তে।
দেশে ফিরে এসে বিশ্রাম নেবার কোন অবকাশ পাননি স্বামীজি। তিনি নিজেও জানতেন দেশের মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য যে গুরু দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেছেন সেখানে বিশ্রাম নেওয়ার মতো কোনো অবকাশ নেই তার। সুতরাং ৩০ কোটি ভারতবর্ষের উদ্ধারের ব্রত গ্রহণ করে তিনি সূচনা করে এবং তার সম্পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি নেন।
১৮৯৮ সালের ৯ই ডিসেম্বর স্বামী বিবেকানন্দ গঙ্গার তীরে বেলুড়ে জমিতে শ্রী রামকৃষ্ণ মঠ স্থাপিত করেন। কিন্তু ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগ রোগ দেখা দেয়।তাই স্বামীজি কলকাতায় ছুটে যান। শিশুদের নিয়ে অসুস্থ মানুষের সেবা করা শুরু করে দেন। রামকৃষ্ণের শিব জ্ঞানে জীব সেবার আদর্শ মূর্তি হয়ে উঠেছিল স্বামীজি।
১৯০১ সালের ৬ ই ফেব্রুয়ারি বেলুড় মঠের ইস ট্রাস্ট ডিড রেজিস্ট্রি হয়। ১০ ই ফেব্রুয়ারি মঠের ট্রাস্টিদের সর্বসম্মতিক্রমে স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ এবং স্বামী সারদানন্দ সাধারণ সম্পাদক হন।
স্বামীজি মঠের সমস্ত কাজকর্ম থেকে প্রকৃতপক্ষে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন কিন্তু কেউ কোনো পরামর্শ চাইলে তিনি তাদের বুদ্ধি মত কাজ করার পরামর্শ দিতেন। অত্যাধিক পরিশ্রম আসামিদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল।
যার কারণে স্বামীজি তাঁর ভক্ত শিষ্যদের খাওয়ার পর নিজ হাতে ধুয়ে দিয়েছিলেন।এজন্য একজন জিজ্ঞাসা করছিলেন আমরা কি আপনার সেবা গ্রহণ করতে পারি?স্বামী যে বলেছিলেন যিশু ও তার শিষ্যদের পা ধুয়ে দিয়েছিলেন। পরের দিন ১৯০২ সালের ৪ ঠা জুলাই সকাল থেকে উৎফুল্ল ছিলেন।
সকলের সঙ্গে একসাথে খেয়ে সন্ধ্যার পর নিজের ঘরে ধ্যানে বসে পড়েন। রাত ৯ টা ৫০ মিনিটে সে ধ্যানের মধ্যে এই মহান ব্যক্তি মহা সমাধি তে ডুব দেন। স্বামী বিবেকানন্দ মাত্র ৩৯ বছর ৬ মাস বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। বাস্তব জীবনে তিনি কখনো কোন মেয়ের সংস্পর্শেই যান নি। যার কারণে তিনি সন্ন্যাসী হয়ে সারা জীবন অতিবাহিত করেন।