১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা করো

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ভূমিকা-ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি বাঙালির জীবন ইতিহাসে অহংকার ও গৌরবের স্মৃতিময় একটি ঘটনা। এই ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে একটি গৌরবের কাহিনী গাঁথা। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ১৯৪৭ সালের পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনের পদক্ষেপ এর সূচনা হয়|  

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে সৃষ্টি হয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের , একটি হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান। দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ার পরেই শুরু হয় দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে মানবিক বৈষম্য। পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তানে মানুষের উপর শুরু করে মানবিক অন্যায় অত্যাচার। তারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। তারা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত দিতে থাকে। এরই প্রেক্ষিতে তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। তারা বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নিতে চায়।

১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জোরালো ভাবে ঘোষনা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা| বাঙালি ছাত্র-জনতা প্রচন্ডভাবে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান। বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য তারা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন।

আরো পড়ুন>>১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে যখন খাজা নাজিমুদ্দিনের কথার পুনরাবৃত্তি করেন তখন বাঙালি ছাত্র-জনতা একুশে ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট আহ্বান করেন। এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে তারা বিক্ষোভ মিছিল করেন। ছাত্রদলের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়| রফিক রফিক সালাম জব্বার বরকত সহ নাম-না-জানা আরো অনেকে নিহত হন। এরই মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

  নিচে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো

১. অফিস আদালতে উর্দু ভাষার ব্যবহার: পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই মুসলিম লীগ সরকার বাঙালি জাতির উপর বিভিন্নভাবে অন্যায় অত্যাচার শুরু করেন। ৫৬ ভাগ লোকের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও অফিস-আদালতে ইংরেজি উর্দু ব্যবহারের পাশাপাশি পোস্টকার্ড প্রকৃতির মতো ছোটখাটো জিনিসে উর্দু ব্যবহার হতে থাকে।

এভাবে সরকার বাঙ্গালীদের অনুভূতিতে আঘাত হানে। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর গঠিত তমুদ্দুন মজলিশ সর্বপ্রথম বাংলা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন।

২. গণপরিষদে  ইংরেজি ও উর্দুর ব্যবহার: ১৯৪৮ সালের ২৩ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার পূর্বেই হবে গণপরিষদের ভাষা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদে ব্যবহার করার দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু তারা এ দাবি মানেনি। এরই প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারাদেশব্যাপী সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করে এবং বিক্ষোভ সমাবেশ এবং বিক্ষোভ মিছিল করে।

আরো পড়ুন>>লাহোর প্রস্তাব কী ? লাহোর প্রস্তাবের মূল বিষয়বস্তু এর পটভূমি ও ফলাফল বর্ণনা করো।

৩. জিন্নাহর ঘোষণা: পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন যে urdu and urdu shall be the state language of pakistan. আর অন্য কোন ভাষা নয়| জিন্নাহর এ সমস্ত উক্তি বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় পূর্ববাংলায় তুমুল বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়|

৪. আরবি হরফে বাংলা লেখার ব্যবহার: বাংলা ভাষাকে বিভিন্নভাবে অপদস্ত করা ছাড়াও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার উদ্দেশ্যে আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করে| এতে বাঙালি জনগণ আরো বেশি ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

৫. খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণা: ১৯৫২সালের ২৬জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এরই প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্রজনতা প্রতিবাদ দিবস পালন করে। তারা ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে।

 ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম| ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিচে আলোচনা করা হলো।

  1. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ: ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তার ঐক্যসূত্র গৃহীত হয় অতি দৃঢ়ভাবে| বাঙালিরা এ কই জাতিসত্তা  বাধা,ভাষা আন্দোলন এটাই প্রমাণ করে। ভাষা আন্দোলন কে তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ এর অন্যতম উপাদান বলা যায়।
  2. অধিকার সচেতনতাবোধ: ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার শিক্ষা পায়। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি অন্যায় অত্যাচার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের শিক্ষা লাভ করেন।

3.সংহতি ও একাত্মবোধ: ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালীদের জাতীয় জীবনে সংহতি ও একাত্মবোধ এর জন্ম দেয়| শুধু  ছাত্ররাই নয় কৃষক শ্রমিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর এক কাতারে শামিল হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে।

  1. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি: ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়। তারা অসাম্প্রদায়িক হওয়ার শিক্ষা লাভ করে।

 5.রাজনীতিতে মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ: ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই পূর্ববাংলার প্রভাবশালী অংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ শুরু হয় এবং রাজনীতির মূল কেন্দ্র বিন্দুতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি উঠে আসে।

  1. শহীদ মিনার স্থাপন: ভাষা আন্দোলনের ফলে শহর ও গ্রামে অসংখ্য শহীদ মিনার স্থাপিত হয় এবং প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়।
  2. স্বাধীনতার অনুপ্রেরণা: স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার  বীজ নিহিত ছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্যে| এই আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙ্গালী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা লাভ করে এবং স্বাধীনতা অর্জন করে|
  3. বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি: ভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ১৯৬২ সালের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে বহাল রাখা হয় ,ফলে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

আরো পড়ুন>>লাহোর প্রস্তাব কী ? লাহোর প্রস্তাবের মূল বিষয়বস্তু এর পটভূমি ও ফলাফল বর্ণনা করো।

 উপসংহার:

 পরিশেষে বলা যায় যে ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য আন্দোলন নয় ,এ আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনের একটি সামগ্রিক আন্দোলনের ফল স্বরূপ। এ আন্দোলন ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও এর রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। আন্দোলনের পর থেকেই বাঙালিরা ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামের পথে অগ্রসর হয় এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিতে সক্ষম হয়।

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর

ভূমিকা: পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ১৯৪৭ সালে দুই পাকিস্তানের (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) জনগণের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সেই বোঝাপড়া বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এর প্রধান কারণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক শ্রেণীর বেপরোয়া আচরণ। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েছে।

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন আরোপের ফলে বৈষম্য, অত্যাচার ও নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬২ সালে, যখন বৈষম্যমূলক জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হয়, তখন আন্দোলন চরমে ওঠে। আর এই আন্দোলনের চাপ সইতে না পেরে আইয়ুব সরকার এই শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয়।

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন

১৯৬২ সালে ছাত্ররা সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তিন স্তরের আন্দোলন শুরু করে। এর মধ্যে শিক্ষা আন্দোলন বা শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন অন্যতম। আইয়ুব খানের উদ্যোগে শিক্ষা কমিশন বা ‘শরিফ কমিশন’ আন্দোলন বেশ কিছু বৈষম্যমূলক প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা শুরু করেছিল। নীচে 1962 সালের শিক্ষা আন্দোলনের প্রবন্ধের আলোচনা-

১. শিক্ষা কমিশন গঠন

সামরিক শাসক আইয়ুব খান একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৫৮ সালের ১২ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি শিক্ষা সচিব ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এস এম শরীফ একটি কমিশন গঠন করেন। এটি শরীফ কমিশন নামে পরিচিত। এই কমিশনের সদস্য সংখ্যা ছিল ১১ জন। ১৯৫৯ সালের ১৪ আগস্ট শরীফ কমিশনের প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করা হয়। প্রতিবেদনটি ১৯৬২ সালে মুদ্রিত এবং প্রকাশিত হয়েছিল।

২. শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ

যৌথ কমিশন ১৯৫৯ সালে প্রণীত হয় এবং ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। এই সুপারিশগুলি নীচে উল্লেখ করা হয়েছে:

ক. ডিগ্রী (পাস) কোর্সের সম্প্রসারণ
১৯৬২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে ডিগ্রি (পাস) কোর্সের মেয়াদ ছিল দুই বছর। কিন্তু শরীফ কমিশনের সুপারিশে ডিগ্রি (পাস) কোর্সের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, নতুন শিক্ষা কমিশন অনুযায়ী ডিগ্রি (পাস) কোর্সের মেয়াদ দুই বছরের পরিবর্তে তিন বছর হবে।

খ. স্কুল ও কলেজের সংখ্যা সীমিত
আইয়ুব খানের প্রবর্তিত শরীফ কমিশন আসলে শিক্ষাবান্ধব কমিশন ছিল না। কারণ শিক্ষার বিকাশ এবং সর্বত্র শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, সমস্ত দেশে শিক্ষা কমিশনগুলি স্কুল ও কলেজগুলির উন্নয়ন এবং তাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সর্বোপরি শিক্ষা এবং শিক্ষকদের উন্নয়নের উপর জোর দেয়। কিন্তু শরীফ কমিশনের সুপারিশ উল্টো প্রতিফলন। কমিশনের সুপারিশ সব জায়গায় স্কুল-কলেজের সংখ্যা সীমিত করা।

গ. অভিভাবকদের উপর শিক্ষার বোঝা বেড়েছে
বিশ্বের সব উন্নত, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার ব্যয়ের ৮০% সরকার বহন করে। কিন্তু শরীফ কমিশনের সুপারিশ এ ক্ষেত্রে উল্টো পথে চলে। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যয়ের বোঝা সরকারের পরিবর্তে অভিভাবকদের ওপর চাপানো হয়। সুপারিশ অনুযায়ী, শিক্ষা ব্যয়ের ৮০ শতাংশ অভিভাবক এবং বাকি ২০ শতাংশ সরকার বহন করবে।

ঘ. ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজি বাধ্যতামূলক
১৯৪৭ সাল থেকে ভাষা ইস্যুতে পাকিস্তানে বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রাম হয়েছে। চাপের মুখে তারা অবিলম্বে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলেও মনের ময়লা পরিষ্কার করতে পারেনি। আর এরই অংশ হিসেবে শরীফ কমিশনের সুপারিশে ষষ্ঠ থেকে স্নাতক পর্যন্ত ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ঙ. উর্দুকে সর্বজনীন ভাষা করা
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ভাষা ইস্যুতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে সঙ্কট চলছে। ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা বারবার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সর্বদা তা প্রত্যাখ্যান করেছে ঘৃণার সাথে এবং প্রতিবাদ করেছে।

আর এই আন্দোলনে বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২ সালে। ফলে পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। যাইহোক, তারা তাদের লেজুড়বৃত্তির প্রকৃতি এড়াতে পারেনি যার ফলে শরীফ কমিশন উর্দুকে পাকিস্তানের সরকারী ভাষা করার উপর জোর দেয় এবং উর্দু ও বাংলা ভাষার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে।

চ. একটি অভিন্ন বর্ণমালা সুপারিশ করা হয়
শরীফ কমিশনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সুপারিশ ছিল অভিন্ন বর্ণমালার সুপারিশ। অর্থাৎ কমিশন পাকিস্তানের জাতীয় ভাষার জন্য অভিন্ন বর্ণমালা প্রণয়নের সুপারিশ করেছিল। কমিশন বিশ্বাস করেছিল যে এটি ভাষার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাবে এবং সর্বত্র কাজকে সহজতর করবে।

ছ. রামন হরফে লেখার চেষ্টা করুন
ভাষা ও বর্ণমালা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা পাকিস্তানি শাসকদের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। আর এর অংশ হিসেবে তারা বর্ণমালার বানান করার চেষ্টা করে। শরীফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, পাকিস্তানি ভাষাগুলো রমন বর্ণমালার সাহায্যে বর্ণমালা করা হবে।

জ. অবৈতনিক শিক্ষা অবাস্তব
১৯৬২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। ফলে দরিদ্র শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা শিক্ষা লাভে আগ্রহী হয়। কিন্তু শরীফ কমিশন এই সুবিধা বাতিলের কথা বলেছে। এতে বলা হয়েছে, অবৈতনিক শিক্ষার ধারণা অবাস্তব।

ঝ. শিক্ষা ব্যয়কে একটি বিনিয়োগ হিসাবে উল্লেখ করুন
শাতরিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় আগ্রহী না হয়ে আগ্রহহীন হতে হবে। শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে যেখানে শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় আগ্রহী করতে বিভিন্ন প্যাকেজ ও বৃত্তি দেওয়ার কথা সেখানে কমিশন উল্টো মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে যে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যয় একটি ব্যবসা হিসাবে বহন করা উচিত।

৩. শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন

১৯৬২ সালের শরীফ কমিশনের কমিউনিস্ট বিরোধী সুপারিশের প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ ফেটে পড়ে। বিভিন্ন আন্দোলন শুরু হয়। নিচে শরীফ কমিশন বা শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করা হলো-

ক. ডিগ্রী স্টুডেন্ট ফোরাম গঠন
শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা প্রথম আন্দোলন শুরু করে। তারা ‘ডিগ্রী স্টুডেন্ট ফোরাম’ গঠন করে এবং আইয়ুব খানের উদ্যোগে শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে দরবার আন্দোলন শুরু করে। ফোরাম কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন কলেজ এতে যোগ দেয়। এর মধ্যে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), ইটেন কলেজ, কায়েদ-ই-আজম কলেজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

খ. পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফোরাম গঠন
শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন বাড়তে থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রনেতারা এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ঘোষণা দেন। আন্দোলন জোরদার করার জন্য ছাত্র সমাজ ডিগ্রী স্টুডেন্ট ফোরাম বিলুপ্ত করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফোরাম গঠন করে। ফলে শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন নতুন মাত্রা নেয়।

গ. স্নাতক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের সমাবেশ
১৯৬২ সালের ১০ আগস্ট ঢাকা কলেজের ক্যান্টিনে স্নাতক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্ররা শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে এক সমাবেশে মিলিত হয়। বৈঠকে তারা পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচির ডাক দেন। ফলে নড়েচড়ে বসেন সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান।

ঘ. হরতাল, বিক্ষোভ ও ধর্মঘট
১৯৬২ সালের ১০ আগস্টের সমাবেশে, ছাত্ররা ১৫ আগস্ট দেশব্যাপী ধর্মঘট এবং ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের সামনে অবস্থানের ডাক দেয়। পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, ছাত্ররা ১৫ আগস্ট দেশব্যাপী ধর্মঘট করে। শরীফ কমিশন বাতিল করুন এবং সেই দিন থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিনের বিক্ষোভের আয়োজন করেন।

ঙ. শিক্ষা দিবস উদযাপন
শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ত্বরান্বিত করার জন্য ছাত্ররা ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ শিক্ষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষা দিবস উদযাপনের জন্য ঢাকার রাজপথে একটি বিশাল প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীদের ক্ষণিকের স্লোগানে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হয়, যা আইয়ুব খানের নজরে আসে।

৪. শিক্ষা কমিশন বিরোধীদের দমন

সামরিক শাসক আইয়ুব খান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সদয় হননি। যে মানুষটির মনে চিরকাল একনায়কতন্ত্রের চিন্তায় বুদবুদ থাকে, ক্ষমতার পতাকা ওড়ানো, যার স্বভাব সে কখনোই এমন যৌক্তিক আন্দোলন মেনে নেবে না। তাই তিনি শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের স্টিমরোলারের নির্দেশ দেন।

তার উত্থাপিত হিংস্র বাহিনী জগন্নাথ কলেজ ও কার্জন হলের ছাত্রদের মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। মাস্তাফিজুর, বাবুল ও ওয়াজিউল্লাহ নামে কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়। তাছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী কার্জন হলের সামনে ১ জন, জগন্নাথ হলের সামনে ৩ জন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়েছেন। এই বিক্ষোভে গোলাম মোস্তফা নামে এক বাস কন্ডাক্টরও মারা যান। ফলে ছাত্র আন্দোলন জঙ্গি রূপ নেয়।

সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তিন দিনের শাইখ পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। যাতে কমিউনিস্ট বিরোধী শরীফ কমিশন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে আইয়ুব সরকার চাপের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং শরীফ কমিশন বাতিল ঘোষণা করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শান্ত হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ছিল সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনগুলোর একটি। ভাষা আন্দোলনের নতুন স্মৃতিকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে আইয়ুব খানের উদ্যোগে শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন স্বৈরশাসকের ভিত নাড়িয়ে দেয়। কারণ কেন্দ্রীয় স্তরে ছাত্রদের দ্বারা শুধুমাত্র শিক্ষাদান করা হতো, এত বড় ও বড় আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে আর ঘটেনি। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সবাই শিক্ষার অধিকারের আন্দোলনে অংশ নেয়। এই আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে জাতীয় চেতনার জন্ম দেয়।