ভূমিকা-ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি বাঙালির জীবন ইতিহাসে অহংকার ও গৌরবের স্মৃতিময় একটি ঘটনা। এই ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে একটি গৌরবের কাহিনী গাঁথা। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ১৯৪৭ সালের পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনের পদক্ষেপ এর সূচনা হয়|
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে সৃষ্টি হয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের , একটি হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান। দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ার পরেই শুরু হয় দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে মানবিক বৈষম্য। পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তানে মানুষের উপর শুরু করে মানবিক অন্যায় অত্যাচার। তারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। তারা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত দিতে থাকে। এরই প্রেক্ষিতে তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। তারা বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নিতে চায়।
১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জোরালো ভাবে ঘোষনা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা| বাঙালি ছাত্র-জনতা প্রচন্ডভাবে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান। বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য তারা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন।
আরো পড়ুন>>১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে যখন খাজা নাজিমুদ্দিনের কথার পুনরাবৃত্তি করেন তখন বাঙালি ছাত্র-জনতা একুশে ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট আহ্বান করেন। এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে তারা বিক্ষোভ মিছিল করেন। ছাত্রদলের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়| রফিক রফিক সালাম জব্বার বরকত সহ নাম-না-জানা আরো অনেকে নিহত হন। এরই মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
নিচে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো
১. অফিস আদালতে উর্দু ভাষার ব্যবহার: পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই মুসলিম লীগ সরকার বাঙালি জাতির উপর বিভিন্নভাবে অন্যায় অত্যাচার শুরু করেন। ৫৬ ভাগ লোকের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও অফিস-আদালতে ইংরেজি উর্দু ব্যবহারের পাশাপাশি পোস্টকার্ড প্রকৃতির মতো ছোটখাটো জিনিসে উর্দু ব্যবহার হতে থাকে।
এভাবে সরকার বাঙ্গালীদের অনুভূতিতে আঘাত হানে। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর গঠিত তমুদ্দুন মজলিশ সর্বপ্রথম বাংলা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন।
২. গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর ব্যবহার: ১৯৪৮ সালের ২৩ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার পূর্বেই হবে গণপরিষদের ভাষা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদে ব্যবহার করার দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু তারা এ দাবি মানেনি। এরই প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারাদেশব্যাপী সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করে এবং বিক্ষোভ সমাবেশ এবং বিক্ষোভ মিছিল করে।
আরো পড়ুন>>লাহোর প্রস্তাব কী ? লাহোর প্রস্তাবের মূল বিষয়বস্তু এর পটভূমি ও ফলাফল বর্ণনা করো।
৩. জিন্নাহর ঘোষণা: পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন যে urdu and urdu shall be the state language of pakistan. আর অন্য কোন ভাষা নয়| জিন্নাহর এ সমস্ত উক্তি বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় পূর্ববাংলায় তুমুল বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়|
৪. আরবি হরফে বাংলা লেখার ব্যবহার: বাংলা ভাষাকে বিভিন্নভাবে অপদস্ত করা ছাড়াও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার উদ্দেশ্যে আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করে| এতে বাঙালি জনগণ আরো বেশি ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
৫. খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণা: ১৯৫২সালের ২৬জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এরই প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্রজনতা প্রতিবাদ দিবস পালন করে। তারা ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে।
ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম| ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিচে আলোচনা করা হলো।
- বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ: ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তার ঐক্যসূত্র গৃহীত হয় অতি দৃঢ়ভাবে| বাঙালিরা এ কই জাতিসত্তা বাধা,ভাষা আন্দোলন এটাই প্রমাণ করে। ভাষা আন্দোলন কে তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ এর অন্যতম উপাদান বলা যায়।
- অধিকার সচেতনতাবোধ: ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার শিক্ষা পায়। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি অন্যায় অত্যাচার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের শিক্ষা লাভ করেন।
3.সংহতি ও একাত্মবোধ: ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালীদের জাতীয় জীবনে সংহতি ও একাত্মবোধ এর জন্ম দেয়| শুধু ছাত্ররাই নয় কৃষক শ্রমিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর এক কাতারে শামিল হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে।
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি: ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়। তারা অসাম্প্রদায়িক হওয়ার শিক্ষা লাভ করে।
5.রাজনীতিতে মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ: ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই পূর্ববাংলার প্রভাবশালী অংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ শুরু হয় এবং রাজনীতির মূল কেন্দ্র বিন্দুতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি উঠে আসে।
- শহীদ মিনার স্থাপন: ভাষা আন্দোলনের ফলে শহর ও গ্রামে অসংখ্য শহীদ মিনার স্থাপিত হয় এবং প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়।
- স্বাধীনতার অনুপ্রেরণা: স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার বীজ নিহিত ছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্যে| এই আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙ্গালী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা লাভ করে এবং স্বাধীনতা অর্জন করে|
- বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি: ভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ১৯৬২ সালের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে বহাল রাখা হয় ,ফলে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
আরো পড়ুন>>লাহোর প্রস্তাব কী ? লাহোর প্রস্তাবের মূল বিষয়বস্তু এর পটভূমি ও ফলাফল বর্ণনা করো।
উপসংহার:
পরিশেষে বলা যায় যে ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য আন্দোলন নয় ,এ আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনের একটি সামগ্রিক আন্দোলনের ফল স্বরূপ। এ আন্দোলন ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও এর রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। আন্দোলনের পর থেকেই বাঙালিরা ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামের পথে অগ্রসর হয় এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিতে সক্ষম হয়।